রুহুল বয়ান, মহেশখালী ::
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের মাথা মালিশ আর নানা রকম গান শুনিয়ে দিনে ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা আয় করে আট বছরের শিশু জাহিদ। এই টাকা সে খরচ করে তার মা আর চার ভাইবোনের সংসারে। যেদিন সাগরপাড়ে পর্যটক কম আসে, সেদিন তার আয়ও কমে যায়। কিন্তু শিশু জাহিদের গাওয়া মধু খই খই… আঞ্চলিক গানটির ভিডিও ইউটিউব, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে দ্রুত পরিচিতি পায় এই শিশু। এখন জাহিদ অনেকের কাছেই পরিচিত। ইউটিউবে জাহিদের গান দেখে সায়মন বিচ রিসোর্ট লিমিডেট চাকরি দিয়েছে শিশু জাহিদকে। এই হোটেলে সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত চলে জাহিদের পরিবেশনায় আঞ্চলিক গান। হোটেলের সামনেই ১১ মে কথা হয় জাহিদের সঙ্গে। ১২ মে তার বাড়িতে গিয়ে আরেক দফা কথা হয়, ছবিও তোলা হয়। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাপলাপুর চরপাড়া এলাকায় জাহিদের জন্ম। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। জাহিদের বয়স যখন চার বছর তখন বাবা নুরুল ইসলামের সঙ্গে জাহিদের মায়ের বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। ভিটামাটি ছেড়ে তার মা চার সন্তানকে নিয়ে কলাতলী সৈকতপাড়ায় জাহিদের নানার বাড়িতে আশ্রয় নেন। ছয় মাস আগে কলাতলী আদর্শ গ্রামে দেড় হাজার টাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করছে জাহিদের পরিবার। বাবা নুরুল ইসলাম তাদের আর খোঁজ নেন না। জাহিদদের সবার বড় ভাই মোহাম্মদ ছৈয়দ হোছাইন সমুদ্রপাড়ে কলা বিক্রি করে কোনো রকম সংসার চালাত। কলা বিক্রি না হলে চুলায় হাঁড়িও উঠত না। জাহিদের বয়স যখন সাত, তখন অভাবের সংসারের হাল ধরতে সেও সমুদ্রপাড়ে গিয়ে পর্যটকদের শরীর মালিশ করে আয় করত। পরে মুঠোফোনে আঞ্চলিক গান শুনে শুনে সে নিজেই বাড়িতে গান মুখস্থ করার চেষ্টা শুরু করে। দুই মাস যেতে না-যেতেই সে দুটি হিন্দি ও ১৮টি আঞ্চলিক গান নিজের গলায় তুলে নেয়। এরপর সৈকতে পর্যটকদের শরীর আর মাথা মালিশ করার পাশাপাশি দুই হাতে তালি দিয়ে আঞ্চলিক গান শুনিয়ে আয় বাড়ায় জাহিদ। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে জাহিদের গানে মুগ্ধ হন ঢাকা থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন ও তাঁর পাঁচ বন্ধু। একপর্যায়ে ইমরানের ইউকেলেলির (গিটারের মতো বাদ্যযন্ত্র) সুরে সুরে গান করতে থাকে শিশু জাহিদ। এ সময় মদু খই খই…, কোন কারণে ভালোবাসার দাম না দিলা… গানের ভিডিও মুঠোফোনে ধারণ করেন ইমরানের এক বন্ধু। গত মার্চে সেই ভিডিও ইমরান ছেড়ে দেন ইউটিউবে। এর পরের ঘটনা শুধু আনন্দের। হোটেল সায়মন কর্তৃপক্ষ জাহিদকে কলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছে। সকাল নয়টা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত স্কুল করে মাকে এক নজর দেখার জন্য জাহিদ যায় আদর্শ গ্রামে। তারপর বিকেলে আবার সায়মন হোটেলে এসে গান শোনানোর চাকরি করে। কলাতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শিরিন জাহান বলেন, ‘জাহিদ স্কুলে নিয়মিত আসে। মাঝেমধ্যে শ্রেণিকক্ষেও সহপাঠীদের গান শোনায় সে।’ কথা প্রসঙ্গে জাহিদ বলে, ‘বাবা বেঁচে থেকেও নেই। দুই মাস ধরে সায়মনে চাকরি করার পর সমুদ্রপাড়ে গান গাওয়ার আর সুযোগ হচ্ছে না। এখন সকালে স্কুলে যাই আর বিকেলে সায়মনে গান গাই। আমি পড়ালেখা শেষ করে গানের একটা সিডি বের করতে চাই।’ আর এই শিশুর মা আম্বিয়া খাতুনও দেখেন এমন স্বপ্ন। ‘জাহিদের টাকা দিয়ে এখন সংসার চলছে। আমার জাহিদ একদিন অনেক বড় শিল্পী হবে—এটা আমার স্বপ্ন। –
পাঠকের মতামত